শুক্রবার, ১৮ মে, ২০১৮

ছলনার আলপনা


              স্বপ্ন ভাঙ্গা দুখ,
বুঝবে সে কেমনে
             যে  হিংসুটে কিংশুক;
পদে পদে বেরিয়ে আসে
বোঝা যায় আসল রুপ।

আমাকে তুই গিয়েছিস ছেড়ে;
তোর সুখের স্বর্গ নেবে কেড়ে,
যতই সুখের রঙিন স্বপ্ন দেখিস
সব কিছু যাবে অনলে পুড়ে।

কখনো বুঝিনি মায়ার ছলনা,
মুগ্ধ হয়ে দেখেছি তোমায়;
তুমি আমার প্রাণের প্রিয়া।

তোমার স্মিত হাসিতে
তাই আজ পথে পথে
এঁকেছি চলেছি আমার হৃদয়ের
অলিগলিতে ছলনার আলপনা।

১৯/০৫/২০১৮

ছন্দ সম্পর্কে জানুন।

’ছন্দ’ শব্দটি বাংলায় এসেছে সংস্কৃত ’ছন্দ:’ বা ’ছন্দস’ থেকে। শব্দটি গঠিত হয়েছে সংস্কৃত শব্দ ’ছন্দ’ (দীপন) এবং অস(র্তৃ) প্রত্যয় যুক্ত হয়ে। দীপন অর্থ দীপ্তিকরণ, শোভন, উদ্দীপন, উত্তেজন। অস্ প্রত্যয়টি এখানে স্ত্রী-বাচক। এটি বিশেষ্য পদ। 'ছন্দ' শব্দটির আভিধানিক অর্থ পদ্যবন্ধ বা পদ্যের বিভিন্ন মাত্রার রচনারীতি বা পদ্য রচনার ছাঁদ বা ভাষার সুষমামণ্ডিত স্পন্দন বা গতির মাধুরী ও স্বাচ্ছন্দ্য। ভাষাবিজ্ঞানী ড.সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতে, বাক্যস্থিত (অথবা বাক্যাংশস্থিত) পদগুলিকে যে ভাবে সাজাইলে বাক্যটি শ্রুতিমধুর হয় ও তাহার মধ্যে একটা কাল-গত ও ধ্বনি-গত সুষমা উপলব্ধ হয় পদ সাজাইবার সেই পদ্ধতিকে ছন্দ (বা ছন্দ: ) বলে। গদ্য রচনার ক্ষেত্রেও ছন্দ-এর এ সংজ্ঞা প্রযোজ্য। আমরা সারা জীবন শুনে এসেছি কবিতা লিখতে ছন্দ লাগেই। আধুনিক গদ্যকার জানেন, গদ্য লেখার জন্যও ছন্দ লাগে। তাই বলে এটা ভাবার কোন কারণ নেই যে ছন্দ আছে বলে গদ্য পদ্য একাকার হয়ে গেছে। গদ্য আর কবিতার চলার ছন্দে পরিষ্কার পার্থক্য আছে। সেই চলার ছন্দটাই একে গদ্য থেকে একটানে আলাদা করে ফেলেছে। অন্ত্যমিল রেখে লেখা কবিতার সাথে গদ্যের পার্থক্য সাদা চোখেই ধরা পড়ে। আধুনিক গদ্য কবিতাকেও গদ্য থেকে সহজেই আলাদা করা যায়। আমাদের সাহিত্যের গদ্য পদ্য সবকিছুর মহান কারিগর রবীন্দ্রনাথের কাছেই চলুন কবিতা আর গদ্যের ফারাকটা বুঝে নিই- গদ্যের নমুনা ’শ্রাবণমাসে বর্ষণের আর অন্ত নাই। খাল বিল নালা জলে ভরিয়া উঠিল। অহর্নিশি ভেকের ডাক এবং বৃষ্টির শব্দ। গ্রামের রাস্তায় চলাচল প্রায় একপ্রকার বন্ধ-- নৌকায় করিয়া হাটে যাইতে হয়।’ (পোস্টমাস্টার/ছোট গল্প) কবিতার নমুনা ’কিনু গোয়ালার গলি। দোতলা বাড়ি লোহার গরাদে-দেওয়া একতলা ঘর পথের ধারেই। (বাঁশি/পুনশ্চ) গানের নমুনা ’এসো শ্যামল সুন্দর আনো তব তাপহরা তৃষাহরা সঙ্গসুধা বিরহিনী চাহিয়া আছে আকাশে’ গদ্যের ভেতর যে ছন্দের দোলা আর কবিতার ছন্দের দোলা খুব সহজেই তার পার্থক্য বুঝতে পারবেন। সব চেয়ে বিস্ময়কর তাঁর গানটি। টানা গদ্যে লেখা গানটিতে যে পেলব গতিময়তা আর ধ্বনিময়তা গলাগলি করে আছে তা এককথায় অপূর্ব, অতুলণীয় এবং গদ্য থেকে একেবারেই আলাদা। আধুনিক কবিতার সাগরে সাঁতার কাটলেও আপনি এ ছন্দোময়তার আবেশে বিভোর হবেন। আমাদের আধুনিক কবিতার পুরোধাদের একজন জীবনানন্দ দাশ। তাঁর কাছেই যাই- ’বলি আমি এই হৃদয়েরে: সে কেন জলের মতো ঘুরে ঘুরে একা কথা কয় ! অবসাদ নাই তার? নাই তার শান্তির সময় ?’ (বোধ/ধূসর পাণ্ডুলিপি) ’সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়ো নাকো তুমি, বোলোনাকো কথা ওই যুবকের সাথে; ফিরে এসো সুরঞ্জনা; নক্ষত্রের রূপালী আগুন ভরা রাতে; (আকাশলীনা/সাতটি তারার তিমির) ’তোমার মুখের দিকে তাকালে এখনো আমি সেই পৃথিবীর সমুদ্রের নীল, দুপুরের শূন্য সব বন্দরের ব্যথা, বিকেলের উপকণ্ঠে সাগরের চিল, নক্ষত্র, রাত্রির জল, যুবাদের ক্রন্দন সব-- শ্যামলী, করেছি অনুভব। (শ্যামলী/বনলতা সেন) নক্ষত্রের রূপালী আগুন ভরা রাতের কথায় বুকের ভেতর কেমন জানি মোচড় দিয়ে ওঠে। সুরঞ্জনা যেন মনের কোনো গহীণে বাঁশি বাজাতে থাকে। শ্যামলী দূর সাগরের দিকে শুধু উড়িয়ে নিতে চায়। একেই কবিতা বলেন গুনীরা ? ছন্দের এমন উতল হাওয়ায় হৃদয় কি আনমনা হয়ে থাকে না ? রবীন্দ্রনাথই বাদ থাকেন কেন ? ’যে আছে আঙ্গিনায় অপেক্ষা করে পরনে ঢাকাই শাড়ী কপালে সিঁদুর।’ (বাঁশি/পুনশ্চ) এ সিঁদুর যে কবিতার নায়ক হরিপদ কেরাণীর সৌজন্যে নয় সে সংবাদের বেদনা বিধুরতাই মনের ভেতর এক ব্যাখ্যাতীত অনুভূতির সৃষ্টি করে। সে অনির্বচনীয় ভাবই কবিতা। ছন্দ কি শুধু গদ্যপদ্যের বিষয় ? মোটেও না। আসলে ছন্দ মিশে আছে আমাদের জীবনের সবকিছুতে। আমাদের হৃৎপিণ্ড বা শ্বাস প্রশ্বাস নিরবচ্ছিন্ন ছন্দে প্রবহমান। সে ছন্দে হেরফের হলেই বিরাট সমস্যা দেখা দেয়। আমাদের দেহের যে গঠন তারও একটা আলাদা ছন্দ বা ছাঁদ আছে। সমগ্র বিশ্বচরারেও এ রকম ছন্দোময়তা মিশে আছে। একটা সামগ্রিক ভারসাম্য নিয়ে সেটা প্রতিষ্ঠিত। তাই ছন্দ ছাড়া কোন সৃজনকর্মই সম্ভব নয়। কবিতা তো নয়ই। কবিতার সাথে ছন্দের যে অবিচ্ছেদ্য মাখামাখি সেটা বোঝার জন্য কবিতা কি বস্তু সেটাও জানা দরকার। কিন্তু গোলমালটা সেখানেই। কবিতা কি ? বহু জনে বহু সংজ্ঞা দিয়েছেন। কেউ কারোটাকে কবিতার সম্পূর্ণ সংজ্ঞা বলে মেনে নেননি। কাব্য রসিকরাও মেনে নেননি। সবাই কবিতার একেকটা বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরেছেন। সবার ভাবনা মিলেই কাব্যরসিকরা কবিতাকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। তবে সবাই কমবেশি একমত,কবিতা কি তার সংজ্ঞা দেয়া সম্ভব নয়। সেটা অনুভব করার বিষয়। গভীর সংবেদনশীল অনুভূতিই আপনাকে কানে কানে জানিয়ে দেবে কোনটা কবিতা, কোনটা কবিতা নয়। তবে সকল গুনীই একটা কথা মেনে নিয়েছেন, ’ভাব দিয়ে কবিতা লেখা হয় না। কথা দিয়ে তাকে সাজাতে হয়।’ (কবিতার কথা/সৈয়দ আলী আহসান) বিখ্যাত ইংরেজ কবি স্যামুয়েল টেলর কোলরিজ গদ্য আর পদ্যের কার্যকর একটা সংজ্ঞা দিয়েছেন। তাঁর বিবেচনায় গদ্য বা Prose হচ্ছে ‘Words in the best order’ অর্থাৎ শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাসই গদ্য। আর কবিতা বা Poetry হচ্ছে ‘Best words in the best order’ অর্থাৎ শ্রেষ্ঠতম শব্দের শ্রেষ্ঠতম বিন্যাসই কবিতা। এর মাধ্যমে কবিতা বা গদ্য কি তা বোঝা কঠিন। কিন্তু গদ্য বা কবিতা কিভাবে লিখতে হবে সেটা খুব ভালো করেই বোঝা গেলো। কবিতা কি সেটা বোঝাবার একটা যুৎসই চেষ্টা করেছেন রবীন্দ্রনাথও। তিনি বলেছেন,’ শুধু কথা যখন খাড়া দাঁড়িয়ে থাকে তখন কেবলমাত্র অর্থকে প্রকাশ করে। কিন্তু সেই কথাকে যখন তির্যক ভঙ্গি ও বিশেষ গতি দেওয়া যায় তখন সে আপন অর্থের চেয়ে আরও বেশি কিছু প্রকাশ করে। সেই বেশিটুকু যে কী তা বলাই শক্ত। কেননা তা কথার অতীত, সুতরাং অনির্বচনীয়। যা আমরা দেখছি শুনছি জানছি তার সঙ্গে যখন অনির্বচনীয়ের যোগ হয় তখন তাকেই আমরা বলি রস। অর্থাৎ সে জিনিসটাকে অনুভব করা যায়, ব্যাখ্যা করা যায় না। সকলে জানেন এ রসই হচ্ছে কাব্যের বিষয়।’ বিষয়টাকে তিনি একটা উদাহরণ দিয়ে পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন-’শ্যামের নাম রাধা শুনেছে। ঘটনাটা শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু যে-একটা অদৃশ্য বেগ জন্মালো তার আর শেষ নেই। আসল ব্যাপারটা হল তাই। সেইজন্যে কবি ছন্দের ঝংকারের মধ্যে এই কথাটাকে দুলিয়ে দিলেন। যতক্ষণ ছন্দ থাকবে ততক্ষণ এই দোলা থামবে না। ’সই,কেবা শুনাইল শ্যামনাম।’ কেবলই ঢেউ উঠতে লাগল। ঐ কটি ছাপার অক্ষরে যদিও ভালোমানুষের মতো দাঁড়িয়ে থাকার ভাণ করে কিন্তু ওদের অন্তরের স্পন্দন আর কোন দিনই শান্ত হবে না।’ (ছন্দ) ছন্দ শব্দের অর্থ যে দীপন বা উদ্দীপন বা উত্তেজন তার প্রয়োগ পাওয়া গেলো কবিতার এ ব্যাখ্যায়। ছন্দ শব্দের যে আভিধানিক অর্থ (ভাষার সুষমামণ্ডিত স্পন্দন বা গতির মাধুরী ও স্বাচ্ছন্দ্য। ) তার সাথেও মিল পাওয়া গেলো। কোলরিজ যে শব্দ সাজিয়ে কবিতা লেখার কথা বলেছেন সেই শ্রেষ্ঠ বিন্যাসই ব্যবহারিক অর্থে ছন্দ। কবিকে তাই কবিতা লিখতে হয় ছন্দ মেনেই। সে কারণে কবিকে ছন্দ শিখতে হয়। কবিতা কি সেটাও শিখতে হয়। শেখার কাজটা চলে কবিতার সাথে নিরন্তর বসবাস করে। প্রকৃতির মধ্যে মানুষই একমাত্র প্রাণী যাকে সবই শিখে নিতে হয়। পাখির ছানা বা ছাগল ছানা স্বাভাবিক জিনিস সহজাত সামর্থ্য দিয়ে শিখে নেয়। হাঁসের বাচ্চা সহজেই জেনে যায় সাঁতার। মানুষকে শিখতেই হয় হাঁটা থেকে শুরু করে কথা বলা, লেখা পর্যন্ত সবই। এই বিধিলিপিও কবিকে ছন্দ শেখার দায়ে আবদ্ধ করেছে। কথা হলো প্রথমেই কি কবি ছন্দ শেখেন ? শেখেন না। শেখেন তখনই যখন সত্যি সত্যি কবি হবার সিন্ধান্ত নেন। রবীন্দ্রনাথও ’জল পড়ে পাতা নড়ে’ ছন্দ শেখার আগেই লিখেছেন। কিন্তু সেখানে থেমে যাননি বলেই তিনি রবীন্দ্রনাথ। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকও অবলীলায় স্বীকার করেছেন, ’পেছনের দিকে তাকিয়ে এখন শিউরে উঠি যে লেখার কৌশল কতখানি কম জেনে -- আরো ভালো, যদি বলি কিছুই না জেনে, একদা এই কলম হাতে নিয়েছিলাম।’ সৈয়দ হক আরেকটা গুরুতর কথা মনে করিয়ে দিতে ভোলেননি-’ লেখাটা কোনো কঠিন কাজ নয়, যে কেউ লিখতে পারেন, কঠিন হচ্ছে, লেখাটিকে একটি পাঠের অধিক আয়ু দান করা।’ (মার্জিনে মন্তব্য) সব কবিই প্রথমে ছন্দ বা কবিতার ভেতরের কারিগরী না জেনে লেখা আরম্ভ করেন। সেটাও ফাঁকা শুরু করেন না। কারো কবিতা পড়ে কিংবা শুনে কবি সে কবিতার প্রেমে পড়েন। প্রেমে পড়া কবিতার আদলটা শিখে নিয়ে তার ছাঁছে গড়েন নিজের প্রথম কবিতা। তার পর ছন্দ শেখা আর কবিতা লেখা শেখার জন্য অন্তরের রক্তক্ষরণের এক কঠিন দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে কবি হয়ে ওঠেন। আমরা এখন ইতিহাসের এমন এক কালপর্বে বসবাস করছি যখন মানববিদ্যার সকল বিষয়ে বহু সাধকের অবদানে একটা বৈশ্বিক কাঠামো তৈরি হয়েছে। প্রতিটি বিষয়ে বহু সোনার ধান ফলেছে। তাই আপনি যদি কোন কাজের ক্ষেত্রে কি কি নেই সেটা না জেনে কাজ শুরু করেন, তাহলে দেখা যাবে বহু আগে আবিষ্কার হওয়া বস্তু আপনি আবার আবিষ্কারের অর্থহীন চেষ্টা করেছেন। ভাবার কোন কারণ নেই যে, আমাদের পূর্বসূরী গুনীরা কারো কাছে কিছু না শিখে নিজের সৃজনশীল কাজ শুরু করেছেন। প্লেটো শিখেছেন সক্রেটিসের কাছে, এরিস্টোটল শিখেছেন প্লেটোর কাছে, মপাশা লেখা শিখেছেন ফ্লবেয়রের কাছে, লালনের গুরু সিরাজ সাঁই। ছন্দ শিখলেই কবি হবেন এর এক কনাও সম্ভাবনা নেই। কিন্তু ছন্দ না শিখে কখনো কবি হওয়া য়ায়নি। অন্তত: এ ব্রক্ষ্মাণ্ডের যে কোন কোনে যিনিই কবি বলে স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি ছন্দ জেনে, ছন্দ মেনে কবিতা লিখেছেন। কবি সমর সেন তাঁর কবিতা থেকে ছন্দকে বের করে দিয়েছেন বলে সবাই বলে থাকেন। আসুন পড়ে দেখি তাঁর একটি কবিতাংশ- ’তুমি যেখানেই যাও, কোনো চকিত মুহূর্তের নি:শব্দতায় হঠাৎ শুনতে পাবে মৃত্যুর গম্ভীর, অবিরাম পদক্ষেপ।’ (তুমি যেখানেই যাও) একটু ভালো করে মন লাগিয়ে পড়ুন। তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারবেন ছন্দের কতো বড়ো কারিগর হলে ছন্দ নিয়ে এমন ছেলেখেলা করা সম্ভব। আরেকটা কথাও এসে যায়। সেটা শিল্পী বা কবির স্বাধীনতার প্রশ্ন। প্রকৃত কবিতো দুরন্ত ,স্বাধীনচেতা। কবি কেন ছন্দের বন্ধন মানবেন ? যদিও জানি, কবি ভালোবাসার বাঁধনের কাছে সদা নতজানু। তারপরও বন্ধনের অধীনতা কেন দরকার তার জবাবটা নিচ্ছি ছন্দের সবচেয়ে বড়ো গুরুদের অন্যতম, রবীন্দ্রনাথের কাছে-’আমরা ভাষায় বলে থাকি কথাকে ছন্দে বাঁধা। কিন্তু এ কেবল বাইরের বাঁধন, অন্তরের মুক্তি। কথাকে তার জড়ধর্ম থেকে মুক্তি দেবার জন্যেই ছন্দ। সেতারের তার বাঁধা থাকে বটে কিন্তু তার থেকে সুর পায় ছাড়া। ছন্দ হচ্ছে সেই তার-বাঁধা সেতার, কথার অন্তরের সুরকে সে ছাড়া দিতে থাকে। ধনুকের সে ছিলা, কথাকে সে তীরের মতো লক্ষ্যের মর্মের মধ্যে নিক্ষেপ করে। ’ (ছন্দ) এখানেই ছন্দের প্রাসঙ্গিকতা। আরেকটা প্রশ্ন উঠতে পারে নতুন যাঁরা কবিতা লিখতে শুরু করবেন তাঁরা ছন্দের কঠিন জগতের ছকে সৃজনশীলতাকে মেলাবেন কিভাবে ? এর জবাবটা নানা জনের জন্য নানা রকম হবে। তবে পাশাপাশি চলতে পারে কবিতা পাঠ,ছন্দ জানা, অলঙ্কার, রসতত্ত্ব আর কবিতার আলোচনা পড়া। এক সময় নবীন কবি আবিষ্কার করবেন ছন্দ তাঁর হাতে খেলতে শুরু করেছে। কবির জন্য শুভ কামনা। ছন্দের জয় হোক।

মঙ্গলবার, ৮ মে, ২০১৮

যখন তুমি আমার হবে?

যখন তুমি              পাখি হবে!
আমি হবো মেঘমুক্ত নীলাকাশ
ডানামেলে             উড়ো তুমি
দেখে চারিদিক হয়োনা উদাস।

যখন তুমি                নদী হবে!
আমি হবো উত্তল সাত সমুদ্দুর
আমার বুকে           ঠাই পেতে
ছুটবে সকাল সন্ধ্যা আর দুপুর।

যখন তুমি            ফুল হবে!
আমি হবো সেই বনের মালী,
মাঝে মাঝে         মধু খাবো
হবো দূরন্ত এক প্রেমি অলি।

যখন তুমি             প্রেম হবে!
আমি হবো প্রেমেরি এক কবি
ছন্দ কবিতা         আর গানে
আঁকবো তোমার নানান ছবি।

যখন তুমি            আমার হবে!
আমরা হবো জীবন মরণ সাথী
সুখে দুঃখে           একই সাথে
রবো আমরা দুজন পাশাপাশি।

বারো মাসের বৈচিত্র্য

ফাগুনেতে কৃষ্ণচূড়ায় লাগে আগুনের ত্যেজ,
চৈত্রতে দারুণ খরা তবুও কৃষকের কাজের নেই শেষ।
বৈশাখেতে ঝড়ো হাওয়াই সকলেই বেসামাল,
জ্যৈষ্ঠ সেতো মধু মাস ফলের বনেও শুনি পাখির গান।
আষাঢ়েতে মেঘলা আকাশে মেঘের গুড়গুড়,
শ্রাবণে উপচে পড়া প্লাবনে নদীর দুই কুল ভাঙা শুরু।
ভাদ্র মাসে তাল পাকে শেয়ালের শুনি হাক,
আশ্বিনেতে ব্যস্ত চাষি দেখে সোনা ফসল হয় হতবাক।
কার্তিকে হাল্কা ঠাণ্ডা চারিদিকে ঘন কুয়াশা,
অগ্রহায়ণে নতুন ফসল চাষির বুকে জাগে নতুন আশা।
পৌষের পিঠা পুলিতে সবার মনে নব জোস,
মাঘের শীতে কাঁপে দেশ সবাই সূর্যের অপেক্ষাতে রোস।
এমনি করে বছর যায় আবার বছর আসে ,
এভাবেই আমরা পাই বারোমাসে আমাদের ছয় ঋতুকে।

রবিবার, ২২ এপ্রিল, ২০১৮

ভবঘুরে

আমি এক ভবঘুরে
আমি ঘুরছি,
পথ থেকে পথে,
বন্ধুর থেকে মসৃণ সমতটে,
শুধুই বৃত্তকারে,
অলিগলি রাজপথ
সব মাড়িয়ে
চলেছি একা
কখনো সঙি ছায়া
কখনো দীপ্ত পায়ে
কখনো ধীর লয়ে
ছন্দের তালে তালে
কখনো বেসুরো লয়ে
আমি ঘুরছি
কখনো ছুটছি
ক্লান্তিহীন চিরন্তন যুবকের বেশে
আমি চলেছি
মহাকাশের উল্কাবেগে
দিনের পর দিন
মাসের পর মাস
বছরের পর বছর
যুগযুগান্তরে
এচলার নেই শেষ
পথ কোথায় শেষ হবে তাও অজানা
আমি ছুটে চলেছি
অজানা অচেনা কোন পথে
কারন আমি ভবঘুরে।

রচয়িতাঃ
শাহাবুদ্দীন
যশোর সদর, যশোর।

মঙ্গলবার, ৬ মার্চ, ২০১৮

বিবেক

মানুষ হয়ে জন্ম নিলেই কি?
মানুষ তারে বলে,
মানুষ হতে বিবেক লাগে,
অনেকে গিয়েছে ভুলে।

বিবেক বুদ্ধি না থাকিলে
কিভাবে সে মানুষ,
পশুরুপি হায়েনা গুলি
সর্বদা থাকে বেহুশ।

মানুষ হতে চাইলে পরে
মনুষ্যত্ব করো ধারণ,
বিবেকটাকে শুদ্ধ করে
পশুত্বকে দাও মরণ।

রচয়িতাঃ

শাহাবুদ্দীন

যশোর সদর,যশোর।

মোবাইলঃ ০১৭২১৪৩৪২২২

শুক্রবার, ২ ফেব্রুয়ারী, ২০১৮

🌾 মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা। 🌾


আমি তোমায় ভালোবাসি’ শুধু তোমাকে
চেতনে-অবচেতনে, উত্থানে-পতনে
শৈশবে-কৈশরে, যৌবনে, ষোলকলা জীবনে
জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে প্রতিধ্বনিত
প্রতিবিম্বিত আর প্রতি সঞ্চালিত
ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি।
মাতৃভাষার প্রতীক অ-আ-ক-খ বর্ণমালা
ব্যঞ্জনের সাথে স্বরবর্ণের ওতপ্রোত ব্যঞ্জনা
তবেই না অতি পরিচিত সর্বত্র প্রচলিত
‘ভালোবাসা’ বর্ণজটের শৈল্পিক উদ্ভবে।
ধনীর অট্টালিকায়, গরীবের কুঁড়েঘরে
নদীর জলজ আস্তরে, বাতাসের
উড়ন্ত শরীরে, ‘ভালোবাসা’ উৎকীর্ণ
সুনীল গগনের কোমল মসৃণ চাদরে।
মাতৃভাষার বদৌলতে এত ভালোবাসা
স্ট্রীটে, পার্কে, স্কুলে, কলেজে, ভার্সিটিতে
মুখে-মুখে, চোখে-চোখে, মননে ও মানে
উপন্যাস, গল্প, কবিতা, ছন্দ ও গানে
ইতিহাসে, বর্তমানে, ভবিষ্যতে, অনুক্ষণে
সংকটে-সংগ্রামে, গভীর ঘন দহনে
স্পর্শে, অনুভবে, আঘাতে-প্রতিঘাতে
ইচ্ছায়-অনিচ্ছায়, অনুযোগ-অনুশোচনায়
ভালোবাসি। মাতৃভাষা ও ভালোবাসা
আমার দু’টি চোখ, চোখের প্রত্যাশা।
তোকেই ভালোবাসি তারুণ্যের উচ্ছাসে
যৌবনের অনুচ্চারিত অলিখিত প্রকাশে
তোর পদতলে একটি শব্দ ‘ভালোবাসা’।
মুখের ধ্বনি, নয়নের মণি, অঙ্গের ইঙ্গিত
ভাবের অনুভব, সবটুকুই মোর মাতৃভাষা।

বৃহস্পতিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৮

পড়া মনে রাখার বৈজ্ঞানিক কৌশল!

পড়া মনে থাকে না’ কিংবা ‘যা পড়ি সব ভুলে যাই’- এগুলো আমাদের অনেকেরই নিয়মিত অভিযোগ। অনেকেই ভাবেন, পড়া-লেখা না থাকলেই বোধ হয় জীবনটা আরো মধুর হত। কিন্তু তা তো আর সম্ভব নয়। তাই পড়ে মনে রাখার জন্য একেকজন একেক কৌশল অনুসরণ করে। কিন্তু এ বিষয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞান কি বলে? চলুন চিকিৎসাবিজ্ঞান বা ডাক্তারি মতে পড়ে মনে রাখার ৯টি কৌশল সম্পর্কে জেনে নেই-

যা শিখতে হবে সে ব্যাপারে আকর্ষণ অনুভব করা: মানুষ যখন কোন বিষয়ের উপর আকর্ষণ অনুভব করে তখন সে তা সহজেই মুখস্ত করে ফেলতে পারে। আমাদের স্মৃতি গঠন বা মেমরি ফর্মেশনের জন্য সব থেকে বড় ভূমিকা পালন করে মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেম (Limbic system)। আরো সুস্পষ্ট করে বললে এই সিস্টেমের হিপ্পোক্যাম্পাস (hippocampus)। হিপ্পোক্যাম্পাস আনন্দ ও কষ্টের অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত। আনন্দ ও কষ্টের বিষয়গুলোর প্রতি আমাদের এক ধরনের আকর্ষণ কাজ করে। তাই এটা সব সময় আনন্দের বা কষ্টের বিষয়গুলোকে দ্রুত স্মৃতি বা মেমরীতে রূপান্তর করে ফেলে। ফলে মানুষ কষ্টের স্মৃতি কখনো ভুলেনা। সাথে সাথে আনন্দের ঘটনাগুলোও স্থায়ী স্মৃতি বা পার্মানেন্ট মেমরি হয়ে যায়। তো, কোন কিছু শিখতে চাইলে আগে বিষয়টির ব্যাপারে আকর্ষণ জাগাতে হবে।

খেয়াল করে চোখ দিয়ে দেখে পড়তে হবে: মানুষ যা কিছু মনে রাখার চেষ্টা করে তার মধ্যে সব থেকে সহজে মনে থাকে ভিজ্যুয়াল মেমরি। অর্থাৎ যা মানুষ চোখে দেখে মনে রাখে। খেয়াল করে দেখবেন, কাউকে কিছু মনে করতে বলা হলে সে ঐ সময়ের ঘটনাটাকে মনে করার চেষ্টা করে। এমনকি পড়া ধরলে অধিকাংশ সময়ই আমাদের চোখের সামনে বইয়ের পৃষ্ঠা ভেসে উঠে। এতে বুঝা যায় মানুষ দেখার মাধ্যমে বা ভিজ্যুয়াল ওয়েতে বেশি শিখে। ফলে মনে রাখার ক্ষমতা বাড়াতে চাইলে বেশি বেশি ছবি, ছক, বইয়ের পৃষ্ঠা ও আনুষাঙ্গিক চিত্র দেখতে হবে।

অল্প অল্প করে মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে: কোন কিছু মনে রাখতে হলে তা বিভিন্ন অংশ বা সেগমেন্টে ভাগ করে পড়া বেশ উপকারী। যেমন ৪৬৭৮৯০-কে মনে রাখা যতটা সহজ তার চাইতে ৪৬৭ ও ৮৯০ এই দুই ভাগে ভাগ করে সংখ্যাটা মনে রাখা বেশি সহজ। আমরা পাঠ্যবইয়ের অনেক অনেক বড় বড় সংজ্ঞা পড়তে ভয় পাই। কিন্তু বড় সংজ্ঞাকে কয়েকভাগে ভাগ করে পড়লে দেখবেন তা সহজেই মনে থাকছে। এর কারণ আমদের ব্রেইন অনেক বড় একটা জিনিসের চাইতে ছোট জিনিসে বেশি মনোযোগ (কনসেনট্রেশন) দিতে পারে। আর তাই বড় পড়াকে ছোট ছোট ভাগ করে মনোযোগ দিয়ে পড়তে হবে। এতে সহজেই পড়া মনে থাকবে।

নতুন শিখতে যাওয়া বিষয়ের সাথে পূর্বে শেখা বিষয়ের সাদৃশ্য খুঁজতে হবে: আমাদের ব্রেইন কোন একটা বিষয়কে নতুন পেলে সে তা পুরানা স্মৃতি বা মেমরির সাথে তুলনা করা শুরু করে। পুরানা মেমরির সাথে মিলে গেলে তা খুব দ্রুত পূর্বের মেমোরির সাথে যোগ করে নেয়। কিন্তু যদি সম্পূর্ন নতুন কিছু শিখতে হয় তবে ব্রেইনকে নতুন করে মেমোরি ট্রী তৈরী করতে হয় যা একটু সময় সাপেক্ষ। এ কারনে পুরনো কোন বিষয়ের সাথে মিলিয়ে পড়লে পড়া খুব সহজে মনে থাকে।

লিখে লিখে পড়ার অভ্যাস করতে হবে: লিখে লিখে পড়লে আমাদের ব্রেইনের অনেক বেশি এলাকা উদ্দীপ্ত (স্টিমুলেটেড) হয়। আবার লেখার সাথে ব্রেইনের যে অংশগুলো জড়িত তা তথ্য (ইনফর্মেশন)-কে স্থায়ী স্মৃতি (পার্মানেন্ট মেমরি)-তে রূপান্তরিত করতে সহায়তা করে। এছাড়া মানুষ কোন কিছু লিখতে চাইলে সেই লেখার প্রতি তার মনোযোগ বেড়ে যায়। এটা দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতি বা পার্মানেন্ট মেমরি তৈরীতে সাহায্য করে।

মার্কার ব্যবহার বা কালারিং করে পড়াও কার্যকর: অনেকে পড়ার সময় মার্কার ব্যবহার করে। এটা বেশ কার্যকর। কারন যখন কোন কিছু মার্ক করা হয় তখন ঐ শব্দটার উপর আগ্রহ ও আকর্ষণ বেড়ে যায়। পাশাপাশি এর উপর ব্রেইনের ভিজ্যুয়াল ইফেক্টও বেড়ে যায়। ফলে মনে রাখতে সুবিধা হয়।

বিকালের পরে বা সন্ধ্যায় পড়াশুনা করা উচিত: বিভিন্ন ডাক্তারি গবেষণায় দেখা গেছে, সকাল ১০ টার আগে মানুষের ব্রেইন পুরোপুরি ক্রিয়াশীল হয় না। এই সময়ের পর থেকে ধীরে ধীরে ব্রেইনের ক্রিয়াশীলতা বাড়তে থাকে। বিশেষ করে বিকালের পরে ব্রেইনের ক্রিয়াশীলতা বেশি বাড়ে। তাই সকালে পড়ার থেকে বিকালে বা সন্ধ্যার পরে পড়া বেশি কার্যকর।

পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে: ব্রেইন মূলত স্মৃতি তৈরীর কাজটা করে ঘুমের ভেতর। গবেষণায় দেখা গেছে, সারা দিনের কাজ ও ঘটনাগুলো ঘুমের সময়েই মেমরিতে রূপান্তরিত হয়। ফলে যেকোন তথ্য (ইনফর্মেশন) মেমরিতে রূপান্তর করতে চাইলে পড়া-লেখার পাশাপাশি পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে।

নিমনিক (mnemonic) ব্যবহার করা: নিমনিক (mnemonic) মানে হচ্ছে মনে রাখার বিশেষ কৌশল। আমাদের ব্রেইন অগোছালো কিছুর চাইতে কৌশলে সাজানো বিষয়ের উপর বেশি মনোযোগ দিতে পারে। ফলে কোন কিছু ছক বা টেবিল আকারে সাজিয়ে নিলে কিংবা নিমনিক (mnemonic) তৈরী করে নিলে দ্রুত মেমোরি তৈরী হয় ও মনে থাকে।

বার বার পড়তে হবে: আমাদের ব্রেইনে ক্ষণস্থায়ী স্মৃতিগুলো (শর্ট টার্ম মেমরি) তখনই দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে (লং টার্ম মেমরী) রূপান্তরিত হয় যখন এটা ইমোশনাল হয় (সুখের বা কস্টের) বা বার বার ইনপুট দেয়া হয় (অর্থাৎ রিপিটেশন করা হয়)। বারবার ইনপুট দিলে ব্রেইনের মেমরি ট্রি অর্থাৎ স্মৃতি গঠনের স্থানে স্থায়ী গাঠনিক পরিবর্তন (স্ট্রাকচারাল চেইঞ্জ) হয়। আর এই স্ট্রাকচারাল চেইঞ্জের ফলেই স্থায়ী বা পার্মানেন্ট মেমরি তৈরী হয়।

                             সমাপ্ত